গুর্জর প্রতিহার রাজবংশ
  • ৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর ভারতে যে শূন্যতা দেখা দেয় তার ফলে যে সমস্ত আঞ্চলিক শক্তির উথান ঘটে তাদের মধ্য গুর্জর প্রতিহার (Gurjara Pratiharas) রাজবংশ অন্যতম।
  • এই বংশের রাজারা নিজেদের সুর্যবংশীয় ও রামায়ণের নায়ক রামচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা লক্ষ্মণের বংশধর বলে দাবি করতেন।
  • আধুনিক ঐতিহাসিকরা মনে করেন খ্রিস্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে হুন জাতির সঙ্গে গুর্জর প্রতিহার ভারতে প্রবেশ করে। ক্রমে তারা ভারতীয় জনসমাজে মিশে যায় এবং ক্ষত্রিয় হিসেবে পরিচিত হয়। প্রথমে তারা পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে রাজপুতানার অন্তর্গত যােধপুরে প্রথম বসতি স্থাপন করে। তাদের এই প্রথম বাসস্থানকে বলা হয় গুর্জরত্রা। এই গুর্জরত্রা থেকে গুজরাট নামের উৎপত্তি। কালক্রমে তারা রাজপুতানা থেকে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয় এবং ব্রোচ ও মালবে দুটি পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।

নামকরনঃ

  • গুর্জর প্রতিহার কথাটি কখনও একত্রে, আবার কখনও আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়। প্রতিহার বংশীয় জনৈক নরপতির একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, প্রতিহাররা হল গুর্জরদের একটি শাখা। বলা হয় যে, এই বংশের আদিপুরুষ লক্ষণ একসময় প্রতিহারী হিসেবে তার অগ্রজ রামচন্দ্রের সেবা করেছিলেন। এ থেকে গুর্জর প্রতিহার কথাটি এসেছে।
  • ডঃ হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী বলেন যে, প্রথমদিকে গুর্জর রাজাদের কেউ কেউ রাষ্ট্রকূট রাজাদের সামন্ত ছিলেন। এই সামন্তদের অনেকে রাষ্ট্রকূটদের যজ্ঞকালে প্রতিহার বা (প্রতিহার কথার অর্থ দ্বারপাল) হিসেবে কাজ করেন। এই কারণে অনেক সমই গুর্জর ও গুর্জর প্রতিহার নামটি একত্রে বা পৃথকভাবে উচ্চারিত হয়। গুর্জর প্রতিহার রাজাদের রাজধানী ছিল কনৌজ।
গুর্জর প্রতিহার বংশের রাজার তালিকা: ১১)

গুর্জর প্রতিহার বংশের ইতিহাস:

  • গুর্জর বংশের প্রতিষ্ঠাতা হরিচন্দ্র। হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণী অনুযায়ী তার রাজধানী ছিল ভিনমাল নামক স্থানে।

প্রথম নাগভট্ট (৭২৫–৭৪০ খ্রিস্টাব্দে):

  • গুর্জর বংশেরই প্রতিহার শাখার রাজা প্রথম নাগভট্ট ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে মালবে এক নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তার রাজধানী ছিল উজ্জয়িনী (মধ্যপ্রদেশ)।
  • তিনি সিন্ধুর আরবদের পরাজিত করে উত্তর ভারতে তাদের অগ্রগতি প্রতিরােধ করেন। এছাড়া তিনি রাজপুতানা ও গুজরাটের কিছু কিছু অঞ্চল নিজ অধিকারভুক্ত করেন।

প্রথম নাগভট্ট এর পর দুজন দুর্বল শাসক কাকুস্ত ও দেবরাজ সিংহাসনে বসেন।

বৎসরাজ(৭৭৫-৮০০ খ্রিস্টাব্দ)

  • তিনি গুর্জর জাতির বিভিন্ন শাখাকে ঐক্যবদ্ধ করে মালব ও রাজপুতানায় নিজ আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
  • উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে তিনি বাংলার পালরাজা ধর্মপালকে পরাস্ত করেন।
  • রাষ্ট্রকুট-রাজ ধ্রুব তাকে পরাজিত করলে তিনি রাজপুতানায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এই সময় থেকে আর্যাবর্তে ত্রি-শক্তির দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর।

দ্বিতীয় নাগভট্ট(৮০০-৮২৫ খ্রিস্টাব্দ)

  • বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন।
  • তিনি সিন্ধু, অন্ধ্র, বিদর্ভ ও কলিঙ্গের উপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন।
  • তিনি কনৌজ আক্রমণ করেন এবং কনৌজে পালরাজা ধর্মপালের প্রতিনিধি চক্রায়ুধ-কে পরাজিত ও বিতাড়িত করে কনৌজ অধিকার করেন।
  • মুঙ্গেরের কাছে এক যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন।
  • রাষ্ট্রকুট-রাজ তৃতীয় গােবিন্দ বুন্দেলখণ্ডের যুদ্ধে দ্বিতীয় নাগভট্টকে পরাজিত করেন।তৃতীয় গােবিন্দ দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলে দ্বিতীয় নাগভট্ট পুনরায় কনৌজ দখল করেন।
  • তার রাজ্যসীমা পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে বাংলা অবধি বিস্তৃত ছিল।

রামভদ্র(৮২৫-৮৩৬ খ্রিস্টাব্দ)

  • দ্বিতীয় নাগভট্ট-এর পর তার পুত্র রামভদ্র সিংহাসনে বসেন, কিন্তু রামভদ্র সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

মিহিরভােজ বা প্রথম ভােজ

  • রামভদ্রের পুত্র মিহিরভােজ বা প্রথম ভােজ ছিলেন প্রতিহার বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক।
  • রাষ্ট্রকূট-রাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণকে পরাজিত করে তিনি মালব ও গুজরাট দখল করেন।
  • তিনি রাষ্ট্রকূট-রাজ দ্বিতীয় ধ্রুবর নিকট পরাজিত হন।
  • পূর্বে বাংলার পাল রাজ্য ও পশ্চিমে সিন্ধুর আরব শক্তি ছিল তার সাম্রাজ্যের দুই সীমা।

প্রথম মহেন্দ্রপাল(৮৮৫-৯১০ খ্রিস্টাব্দ)

  • মিহিরভােজের পর তার পুত্র প্রথম মহেন্দ্রপাল সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি পাল-বংশীয় রাজা নারায়ণপাল-কে পরাজিত করে মগধ এবং উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

দ্বিতীয় ভােজ(৯১০-৯১২ খ্রিস্টাব্দ)

  • প্রথম মহেন্দ্রপালের পর তার পুত্র দ্বিতীয় ভােজ সিংহাসনে বসেন।
  • তিনি তার ভ্রাতা প্রথম মহীপাল কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হন।

প্রথম মহীপাল

  • দ্বিতীয় ভােজকে সিংহাসনচ্যুত করেন।
  • রাজশেখর তাকে আর্যাবর্তের মহারাজাধিরাজ বলে অভিহিত করেছেন।
  • রাষ্ট্রকুট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্র তাকে পরাজিত করেন এবং কনৌজ, সৌরাষ্ট্র দখল করে নেন।
  • পরবর্তীকালে রাষ্ট্রকুট-রাজ তৃতীয় কৃষ্ণ কালাঞ্জর এবং চিত্রকুট বা চিতোর দখল করে নেন।

পরবর্তী শাসক এবং গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্যের পতনঃ

প্রথম মহীপালের পরবর্তী শাসকগণ হলেন দ্বিতীয় মহেন্দ্রপাল, দেবপাল, বিনায়কপাল, দ্বিতীয় মহিপাল, দ্বিতীয় বিজয়পাল, রাজ্যপাল, ত্রিলোচনাপাল, যশপাল। প্রথম মহীপালের আমল থেকে গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্য পতন শুরু, তা তার দুর্বল উত্তরাধিকারীদের পক্ষে রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাদের দুর্বলতার সুযোগে বুন্দেলখণ্ডে চন্দেল, চেদিতে কলচুরি, মালবে পারমার এবং গুজরাটে চালুক্য বংশের উৎপত্তি ঘটে। ১০১৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান মামুদের আক্রমণে কনৌজ লুষ্ঠিত হলে গুর্জর প্রতিহার শক্তির চুড়ান্ত পতন ঘটে।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য(Some Important Facts)

  • ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন প্রতিহার সাম্রাজ্যকে প্রাচীন ভারতের শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য বলে অভিহিত করেছেন।
  • আরব পর্যটক সুলেমান বলেন যে, ভারতের প্রতিহার রাজাদের ন্যায় ইসলামের প্রধান শত্রু আর কেউ ছিল না।
  • আরব আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকর্তা হিসেবে রাজা ভােজ আদি বরাহ (বিষ্ণুর বরাহ অবতার) উপাধি ধারণ করেন।
  • প্রখ্যাত সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার রাজশেখর প্রথম মহেন্দ্রপাল ও মহীপালের রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন।
  • তাদের মন্দিরের নির্মাণশৈলীর সর্বাধিক বিকাশ ছিল খাজুরাহোতে